২০২৩ সালে বাংলাদেশ প্রথম বারের মতো চালু হলো সর্বজনীন পেনশন স্কিম। এই স্কিমের আওতায় সরকারী চাকরিজীবী ব্যতীত দেশের সকল নাগরিক পেনশন সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পর এটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ কারো বয়স যদি ১৮ থেকে ৫০ এর মধ্যে হয়। তাহলে অনলাইনে আবেদন পূর্বক এই সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশ নিতে পারবেন।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম কি?
পেনশন হলো এমন একটি সিস্টেম বা পদ্ধতির নাম যেটি সরকারি চাকরিজীবীরা তাদের চাকরির বয়স শেষে হওয়ার পর সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অর্থিক সহায়তা বা অনুদান পেয়ে থাকেন। যা তাদের বার্ধক্যকালে জীবন চলাচলে বিশেষ সহয়তা প্রদান করে। একই পদ্ধতিতে কাজ করবে সর্বজনীন পেনশন স্কিম ২০২৩। তবে এটি সরকারি চাকরিজীবী ব্যতীত অন্য সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সুবিধা সমূহ
সর্বজনীন পেনশন স্কিম অনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলেও নানাবিধ প্রশ্ন থেকে যায় এর সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে। যেমন: কিভাবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আবেদন করব? কোথায় বা কিভাবে টাকা জমা করব, সর্বনিম্ন কত টাকা জমা দিতে হবে এবং এর লাভ বা মুনাফার হার কত শতাংশ? ইত্যাদি।
জাতীয় পেনশন কর্তিপক্ষ বলছে সর্বজনীন পেনশন দেশের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের টেকসই ও সুসংগঠিত শারীরিক নিরাপত্তা প্রদান করবে। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যেকোন পেশার নাগরিক এই স্কিমে অংশ নিতে পারবে। তবে যাদের বয়স ৫০ বছরের উর্ধ্বে তারাও চাইল সর্বজনীন স্কিমে আবেদন করতে পারবে। এক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তিকে টানা ১০ বছর চাঁদা দিয়ে যেতে হবে। যখন তার বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হবে তখন তিনি সরকার কর্তৃক পেনশন পেতে থাকবেন।
আরোও পড়ুন: মোবাইল দিয়ে ৩ মিনিটে জন্ম নিবন্ধন বাংলা থেকে ইংরেজি করুন।
ব্যক্তি ও পেশাবেদে প্রত্যেক মাসে কম পক্ষে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে কেউ চাইলে মাসিক অথবা ৩ মাস পরপর এই চাঁদা দিতে পারবে। তবে বিশেষ প্রয়োজনে ১ বছর পর একসাথে সম্পূর্ণ চাঁদা পরিশোধ করতে পারবে। অর্থিক সমস্যার কারণে চাঁদা দিতে বিলম্ব হলে জাতীয় পেনশন কর্তিপক্ষকে বিষয়টি জানিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় বিলম্বের ফি হিসেবে এক মাস পর থেকে ১% হারে দৈনিক বিলম্ব ফি দিতে হবে।
কেউ যদি টানা ৩ কিস্তি চাঁদা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার একাউন্টি স্থগিত করা হবে। তবে বিশেষ সমস্যার কারণে চাঁদা দিতে না পারলে সেটি জাতীয় পেনশন কর্তিপক্ষের নিকট জানাতে হবে। তাহলে ১২ মাস পর্যন্ত চাঁদা দিতে না পারলেও একাউন্টটি স্থগিত করা হবে না।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো। এই স্কিমে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি আজীবন অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত পেনশনের টাকা উপভোগ করতে পারবেন। আবার পেনশনার বিশেষ প্রয়োজনে টাকা তুলতে চাইলে, আবেদন পূর্বক তার মোট জমাকৃত অর্থের ৫০ শতাংশ টাকা ঋণ হিসেবে নিতে পারবেন।
তবে বিশেষ কারণে যদি উক্ত ব্যক্তি মারা যান তাহলে নমিনি এই টাকা গ্রহন করতে পারবেন। আর যদি পেনশনার ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগেই মারা যান তাহলে পেনশনের টাকা মুনাফাসহ তারা নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। তবে গ্রাহক ও নমিনি উভয়ে মারা গেলে উত্তরাধিকারী সুত্রে এই টাকার ভাগ পাবেন তার ওয়ারিশরা।
পেনশন স্কিমের ধাপ কয়টি ও কি কি?
জাতীয় স্কিম কর্তিপক্ষ ৬টি স্কিম চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে চালু হয়েছে ৪টি স্কিম। যেমন:
- প্রবাস
- প্রগতি
- সুরক্ষা ও
- সমতা
প্রবাস স্কিম: প্রাবাস স্কিমটি সুধু মাত্র দেশের বাহিরে কর্মরত বা অবস্থানকারী নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য হবে। এর মাসিক চাঁদার হার ধরা হয়েছে যথাক্রম ৫,০০০, ৭,৫০০ ও ১০,০০০ টাকা। ব্যক্তি চাইলে এই চাঁদা ওনি যেদেশে অবস্থান করছেন সেই দেশের মুদ্রায় পরিশোধ করতে পারবেন। আবার দেশে ফিরে আসলে দেশিও মুদ্রায় চাঁদা পরিশোধের ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়াও বিশেষ প্রয়োজনে প্রবাসী স্কিম পরিবর্তনেরও সুযোগ রয়েছে।
প্রগতি: এই পেনশন স্কিমটি বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের জন্য। এই স্কিমে মাসিক চাঁদার হার ধরা হয়েছে ২,০০০/ ৩,০০০/ ৫,০০০ টাকা। আবার চাইলে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের মালিক ও এই স্কিমে অংশগ্রহন করতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে মোট টাকার অর্ধেক কর্মচারী ও বাকি অর্ধেক প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে।
সুরক্ষা: এই স্কিমটি মূলত স্বনির্ভর ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ যারা কোন কাজ করছে না, কিন্তু নিজে অর্থ উর্পাজন করতে সক্ষম। যেমন কৃষক, শ্রমিক কিংবা ফ্রিল্যান্সার ইত্যাদির পেশার মানুষেরা। এই স্কিমে চাঁদার হার ধরা হয়েছে মাসিক ১,০০০/ ২,০০০/ ৩,০০০/ ৫,০০০ টাকা।
সমতা: এই স্কিমটি দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসরত স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য। এখানে চাঁদার হার ধরা হয়েছে মাসিক ১,০০০ টাকা। যার অর্ধেক অর্থাৎ ৫০০ টাকা বহন করবে সরকার এবং বাকি ৫০০ টাকা বহন করবে সমতা গ্রাহক। তবে এটি নির্ণয় করবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরো। মূলত বছরে যাদের বাৎসরিক আয় ৬০ হাজার টাকার মধ্যে সুধুমাত্র তারাই এই স্কিমে অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবেন।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করতে কি কি লাগবে?
পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করতে একজন আবেদনকারীকে নিম্নে তথ্যগুলো আবেদন করার সময় সাবমিট করতে হবে।
- জাতীয় পরিচয়পত্র (বাধ্যতামূলক)
- অথবা পাসপোর্ট (NID না থাকলে)
- মোবাইল নম্বর
- ছবি
- ইমেইল
- ব্যাংক একাউন্ট
- নমিনির NID নম্বর
একাউন্ট খোলার পর। কিছুদিন পর থেকে অনলাইন ও যেকোন মোবাইল ব্যাংকিং -এ চাঁদা পরিশোধ করা যাবে। তবে আপাদত সোনালী ব্যাংকে সর্বজনীন স্কিমের হিসেব খোলা হয়েছে। যেকোন ব্যক্তি সরাসরি সোনালী ব্যাংকে উপস্থিত হয়ে সর্বজনীন পেনশনের একাউন্ট তৈরি ও চাঁদা পরিশোধ করতে পারবে।
অনলাইনে সর্বজনীন পেনশনে একাউন্ট খোলার নিয়ম
আপনি চাইলে ঘরে বসে অথবা দেশের বাহিরে থেকে অনলাইনের মাধ্যমে সর্বজনীন পেনশন একাউন্ট তৈরি করতে পারবেন। অনলাইনে পেনশন স্কিম একাউন্ট খোলার জন্য যেকোন ব্রাউজার থেকে চলে আসুন এই ঠিকানায় pension.gov.bd। এখানে আসার পর আপনি একটি প্রত্যায়ন পাতা বা ট্রামস এন্ড কন্ডিশন দেখতে পাবেন। যার নিচে লেখা থাকবে ‘আমি সম্মত আছি’ (I am agree) এখন আমি সম্মত অপশনে ক্লিক করে শুরু করুন আপনার রেজিস্ট্রেশন।
*১ম ধাপ: প্রথম ধাপে আপনার NID অর্থাৎ জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, মোবাইল নম্বর, ইমেল এড্রেস দিয়ে নিচে থাকা ক্যাপসাটি পূরণ করে পরবর্তী অপশনে ক্লিক করুন।
*২য় ধাপ: ২য় ধাপে আপনার দেওয়া প্রদত্ত নম্বরে ৬ ডিজিটের একটি OTP কোড যাবে। সেটি সংগ্রহ করে ওয়েবসাইটে বসিয়ে পরবর্তী বাটনে ক্লিক করুন।
*৩য় ধাপ: এই ধাপে আবেদনকারীকে স্কিমসমূহের থেকে তার জন্য প্রযোজ্য স্কিমটি বেছে নিতে হবে। যেমন: প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা।
*৪র্থ ধাপ: ৪র্থ ধাপে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী আবেদনকারীকে তারা ব্যক্তিগত তথ্য যেমন: বাংলা ও ইংরেজি নাম, ছবি, পিতা-মাতার নাম, আবেদনকারীর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, পেশা, বাৎসরিক আয় ইত্যাদি তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করে পরবর্তী বাটনে ক্লিক করতে হবে।
*৫ম ধাপ: ৫ম ধাপে স্কিম অনুযায়ী আবেদনকারীকে মাসিক চাঁদার পরিমান নির্ধারণ করে পরবর্তী বাটনে ক্লিক করতে হবে।
*৬ষ্ঠ ধাপ: এই ধাপে আবেদনকারীকে তার ব্যাংকের তথ্য সাবমিট করতে হবে। যেমন: ব্যাংকের নাম, ধরণ, শাখার নাম, হিসেবের নম্বর ইত্যাদি। সবগুলো তথ্য পূরণের পর পরবর্তী অপশনে ক্লিক করতে হবে।
*৭ম ধাপ: ৭ম ধাপে আবেদনকারীর নমিনির তথ্য যেমন: তারা জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও জন্ম তারিখ, মাস ও সাল দিয়ে নমিনিকে যুক্ত করতে হব।
*৮ম ধাপ: ৮ম ধাপে আবেদনকারীকে তার সম্পূর্ণ তথ্য গুলো আরোও একবার দেখানো হবে। সেখানে ভুল থাকলে পূর্ববর্তী বাটনে ক্লিক করে ভুল সংশোধন করে নিতে হবে। আর সব ঠিক থাকলে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট গুলো সংযুক্ত করে সাবমিট বাটনে ক্লিক করে আবেদন সম্পন্ন করতে হবে।
তবে আবেদনে কোন ভুল থাকলে সেই আবেদন বাতিল বলে বিবেচিত হবে এবং একই সাথে জমাকৃত অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন পেনশন কর্তিপক্ষ।
অফলাইনে পেনশন স্কিম একাউন্ট খোলার নিয়ম
আপনি চাইলে অনলাইন ছাড়াও অফলাইনে পেনশন স্কিম একাউন্ট খোলার আবেদন করতে পারেন। অফলাইনে পেনশন স্ক্রিম একাউন্ট খোলার আবেদন করতে। নিকটস্থ সোনালী ব্যাংকের যেকোনো শাখায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে আবেদন করতে হবে।
অনলাইন অথবা অফলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রে একই ডকুমেন্টগুলো প্রযোজ্য হবে। এছাড়াও আপনি চাইলে সরাসরি সোনালী ব্যাংক থেকে পেনশনের চাঁদা পরিশোধ করতে পারবেন।
সর্বজনীন পেনশন সম্পর্কিত প্রশ্নবলি
প্রশ্ন: পেনশনের টাকা কিভাবে জমা করতে হবে?
উত্তর: যারা পেনশনে অংশগ্রহন করবেন তাদের প্রত্যেকের একটি করে ইউনিক আইডি দেওয়া হবে। যার মাধ্যমে চাঁদা পরিশোধ করা যাবে।
প্রশ্ন: চাকরি পরিবর্তন করলে ইউনিক আইডি পরিবর্তন হবে কিনা?
উত্তর: না, সারা জীবন একটি ইউনিক আইডি ব্যবহার করতে হবে। তবে চাকরি পরিবর্তন করলে সেই তথ্য জাতীয় পেনশন কর্তিপক্ষকে জানাতে হবে।
প্রশ্ন: সর্বজনীন পেনশন স্কিমে গৃহিণীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা?
উত্তর: হ্যা, সুরক্ষা স্কিমে গৃহিণীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে।
প্রশ্ন: সরকারি কোন কর্মচারী বা কর্মকর্তা এই স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা?
উত্তর: না, এটি সরকারী কর্মচারী বা কর্মকর্তাদের জন্য এখন পর্যন্ত উন্মুক্ত করা হয়নি।
প্রশ্ন: পেনশন কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের বেতন বাতা সরকার দিবে নাকি জনগণকে দিতে হবে?
উত্তর: পেনশন কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের সকল বেতন ও বাতা সরকার নিজ খরচে বহন করবেন।
প্রশ্ন: সরকার পরিবর্তন হলে পেনশনের টাকার কি হবে?
উত্তর: এটি একটি জনকল্যাণ মূলক উদ্ধোগ। তাই সরকার পরিবর্তন হলেও পেনশনের টাকার ক্ষতি হবে না বলে জানিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারণ নতুন সরকার গঠন হলেও তারা দেশের মানুষের কথা বিবেচনা করে এই কর্যকর্ম অব্যাহত রাখবেন বলে আশা করা যায়।
প্রশ্ন: প্রবাসীরা এই স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা?
উত্তর: হ্যা, অনলাইনে পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে প্রবাসীরা প্রবাস স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
[…] […]